আচঁলে মেঘনার মায়া ডাকাতিয়া বুকে রহমতখালি বয়ে চলে মৃদু এঁকে বেঁকে নারিকেল সুপারি আর ধানে ভরপুর আমাদের আবাস ভূমি প্রিয় লক্ষ্মীপুর লক্ষ্মীপুর জেলাআপনাকে সুস্বাগতমবাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত লক্ষ্মীপুর জেলার আয়তন ১৫৩৪.০৭ বর্গ কিঃমিঃএ জেলার উত্তরে চাঁদপুর, পূর্বে নোয়াখালী, দক্ষিন পশ্চিমে মেঘনা নদী এবং অপর পাড়ে ভোলা ও বরিশাল জেলাএ জেলা ছোট বড় অনেক নদী ও খাল নিয়ে মেঘনা বিধৌত অঞ্চল

বুধবার, ১৫ আগস্ট, ২০১২

লক্ষ্মীপুর জেলার ইতিহাস


যে ভূখন্ড নিয়ে বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলা অবস্থিত তার আদি চিত্র এ রকম ছিল না। অধিকাংশ স্থানে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালা ক্রীড়ায় মত্ত থাকত। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তাঁর ‘সিউতী’ নামক ভ্রমণ বৃত্তান্তে ‘কমলাঙ্ক’কে সমুদ্র তীরবর্তী বলে বর্ণনা করেছেন। ‘কমলাঙ্ক’ বর্তমানে কুমিলা ও পূর্ববর্তী ত্রিপুরা জেলার প্রাচীন নাম। কবি কালিদাস তাঁর ‘রঘু বংশ’ কাব্যে ‘সুষ্মি দেশকে’ ‘তালিবন শ্যামকণ্ঠ’ বলে অভিহিত করেছেন। কুমিলা জেলার দক্ষিণাংশ এবং নোয়াখালীর উত্তরাংশকে ‘সুষ্মি দেশ’ বলে বুঝিয়েছেন। প্রাচীনকাল থেকে এ এলাকা সমূহে প্রচুর তালবৃক্ষ জন্মে। কথিত আছে, ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দশকের গোড়ার দিকে ভুলুয়া রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বস্বর শুর মুর্শিদাবাদ থেকে চট্টগ্রামে (চাটগাঁও) নৌকা যোগে চন্দ্রনাথ তীর্থ দর্শনে যাবার পথে এ অঞ্চলে আসেন। এটি ছিল নিশ্চিতই নতুন জাগা চর। হয়তো তৎকালে
ত্রিপুরা জেলার সাথে সম্পৃক্ত রায়পুর ও রামগঞ্জের উত্তরের ক্ষুদ্রতম কোন একাংশ প্রাচীন ভূখন্ড ছিল। বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলার অধিকাংশ ভূমি, নদী বা সমুদ্র গর্ভ থেকে ক্রমশ চর বা দ্বীপ হিসেবে জেগে উঠে। এ জন্য জেলার বিভিন্ন এলাকার নামে সাথে চর, দ্বী, দি, দিয়া যুক্ত হয়। যে সব এলাকার সাথে পুর বা গঞ্জ যুক্ত হয়েছে সেগুলিও প্রাচীনতম নয়। নতুন বসতি স্থাপনকারিগণ এসব যুক্ত করেছেন। মাত্র ২ শত বছর পূর্বে এ অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি প্রত্যক্ষ করে স্কটিশ ভ্রমণকারী ড. ফ্রান্সিস বুকানন লিখেছেন (২ মার্চ ১৭৯৮) ‘‘সম্ভবত বিভিন্ন সময় চর ছিল অথবা এমনও হতে পারে এ অঞ্চল নদীর বালুকা নিয়ে গড়ে উঠেছে। সব জায়গায় মাটি নরম, ঢিলেঢালা; তার সঙ্গে মিশ্রিত আছে অভ্রাল বালু কণা এবং এ মাটির স্তর বিন্যস্ত নয়। তাছাড়া কাদামাটি এখানে নেই বললেই চলে। (৫ মার্চ ১৭৯৮) পাতা হাট (চরপাতা, রায়পুর) এবং লক্ষ্মীপুরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে যে রকম চাষাবাদ করা হয়েছে, লক্ষ্মীপুর এবং নোয়াখালীর মধ্যবর্তী এলাকা অতটা আবাদি নয়। গাছ গাছালির ফাঁকে ফাঁকে গ্রামীণ মানুষের বসত বাড়ি বেশ ছাড়া ছাড়া এবং অনেক অঞ্চল এখনও প্রাকৃতিক অবস্থায় পড়ে আছে। পাতা হাটের তুলনায় এখানকার জমিন নিচু এবং প্রত্যেক ডোবা সুন্দরবনের গাছ গাছালিতে ভরা।’’ নোয়াখালীর ইতিহাস লেখক প্যারী মোহন সেন (১৯৪০)-এর বর্ণনায় দেখা যায় যে, ‘‘লক্ষ্মীপুর অঞ্চল এক সময় বঙ্গোপসাগরের অংশ ছিল। এক সময় যে স্থানে ভীষণ ঊর্মিমালা উত্থিত হইয়া মানবের ভীতি সঞ্চার করিত, সেই স্থান এক সময়ে অর্ণবচরগণে পরিব্যাপ্ত ছিল। অধুনা সেই স্থানে বহু সংখ্যক মানব সুখে সাচ্ছন্দ্যে কালাতিপাত করিতেছে।’’ ড. কাদের (১৯৯১)-এর বর্ণনায় দেখা যায়, ‘ফেনী নদীর পশ্চিম মেঘনা নদীর পূর্ব, ত্রিপুরা (কুমিলা) জেলার অন্তর্গত মেহারের দক্ষিণ এই বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগই সমুদ্র গর্ভজাত।’ এখানে নতুন ভূমি জেগে উঠলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ চাষাবাদ উপলক্ষে এবং আরব দেশের বহিরাগতরা ব্যবসা বানিজ্যি ও ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে জনবসতি গড়ে তোলে। তারপর মেঘনা নদী ভাঙা-গড়ার মধ্যে এবং প্রতিকূল প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে করে লক্ষ্মীপুরের মানুষ টিকে আছে। এক সময়ের সমৃদ্ধ নগরী ইসলামাবাদ মেঘনা নদীর গর্ভে বিলীন হয়, কালক্রমে নদী গর্ভে আরো বিলুপ্ত হয় সমুদ্র উপকূলবর্তী ও মেঘনা নদীর তীরবর্তী অনেক জানা-অজানা প্রসিদ্ধ জনপদ ও শহর-বন্দর ইবনে বতুতার বর্ণনায় যার উলেখ আছে।

আজকের লক্ষ্মীপুর জেলা যে ভূ-খন্ড নিয়ে গঠিত ইতিহাসে তার কোন অতীত অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুস্কর বলে সমকালীন ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন সময় মন্তব্য করেছেন। বিশ্বম্ব^র শুরের ‘ভুলুয়া’ রাজ্য পত্তনের সময় থেকে এ এলাকাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা যায়। এসময় পশ্চিমের মেঘনা নদী পর্যন্ত ভুলুয়া সীমানা বিস্তৃত ছিল। এ হিসেবে লক্ষ্মীপুর জেলা ভুলুয়ার অধীন ছিল। চুতর্দশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ ভুলুয়া জয় করেন। এখানে তিনি পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী স্থাপন করেন এবং একজন শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। মেঘনা উপকূলীয় সীমান্ত রক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী নৌ-ঘাটি স্থাপন করা হয়। তখন প্রমত্তা মেঘনা নদী ফরাশগঞ্জ ও ভবানীগঞ্জের উপর দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত ছিল। উলেখ্য, ভুলুয়া পরগণায় ভুলুয়া নামক একটি গ্রাম ছিল, যা মাইজদী (নোয়াখালী) শহরের দক্ষিণ পশ্চিমের ১৫ মাইল এবং ভবানীগঞ্জের (লক্ষ্মীপুর) ৩ মাইল পূর্বে ছিল। বর্তমান শহর কসবা ও তেওয়ারীগঞ্জ গ্রাম গুলির কোন এক জায়গায় ভুলুয়া গ্রামের সীমানা ছিল।

সপ্তদশ শতাব্দিতে মুঘলরা ভুলুয়া দখল করে। এ নৌ-খাঁটি মুঘল যুগে ‘শহর কসবা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে যা ছিল পূর্বাঞ্চলে মুঘলদের প্রধান নৌ-ঘাঁটি। সপ্তদশ শতাব্দির মধ্য ভাগে সম্রাট শাহজাহানের সময় বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁন সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রামে পর্তুগীজ জলদস্যু ও আরাকানদের বিরুদ্ধে অভিযানকালে ঢাকার ‘লালবাগ দূর্গ’ থেকে পাঠালেন স্থল বাহিনী; চাঁদপুরে ডাকাতিয়া ও মেঘনা নদীর পথ ধরে শহর কসবায় এসে নৌ-বাহিনীর সাথে মিলিত হয়। এভাবে লক্ষ্মীপুর জেলার দক্ষিণ ও পশ্চিম সীমানা চিহ্নিত করা যায়। উত্তর ও পূর্ব সীমানা বর্তমান বরাবরই বহাল ছিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন